একটি সংবাদ মাধ্যমের ভিডিওতে দেখা গেছে দূরে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ হচ্ছে। এর মধ্যেই এক ফিলিস্তিনি বাবা তার সন্তানের হাত ধরে সম্ভবতঃ নামাযে যাচ্ছেন। আর তার পাশেই শিশুরা খেলা করছে।
এখন পর্যন্ত ১১ জন মহিলা ও ২৭ জন শিশুসহ ১০৩ জন ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন।
এর জবাবে হামাসের রকেট হামলায় ইসরায়েলি মারা গেছেন ৭ জন।
ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে ফিলিস্তিনি জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ভাঙচুরের খবরও দেখা যাচ্ছে।
হামলার জবাবে হামাস ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো অজস্র রকেট নিক্ষেপ করতে সমর্থ হয়েছে। ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রকেট ঠেকাতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে।
ইসরায়েলের রাজধানীতে প্রধান বিমান বন্দর বন্ধ হবার ফলে দেশটির দক্ষিনাঞ্চলে সেটির জরুরী বিকল্প হিসেবে রামোন বিমান বন্দর চালু করা হয়েছিলো।
হামাসের রকেট সেই এলাকাতেও পৌছে গেছে।
ইরান হামাসকে রকেট টেকনোলজি সরবরাহ করে থাকে।
মনে হচ্ছে ইরানের জেনারেল সোলায়মান কাসেমীর হত্যাকাণ্ডে খেপে গিয়ে ইরান হামাসকে হাত খুলে উন্নততর দূর পাল্লার রকেট টেকনোলজি আর ড্রোন সরবরাহ করেছে। সেই কারণে হামাসের ড্রোন হামলার খবরও দেখা যাচ্ছে।
অতীতে লেবাননের শিয়া সংগঠন হিযবুল্লাহর গেরিলারা ২০০৬ সালের যুদ্ধে লেবানন থেকে হাজার হাজার রকেট মেরে ইসরায়েলের অবস্থা কাহিল করে দিয়েছিলো।
সেই যুদ্ধে ইসরায়েলের ১২১ জন সৈন্য মারা যায় এবং ২০টা ট্যাংক ধ্বংস হয়। যদিও হিযবুল্লাহর দাবি ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি এর বহুগুণ বেশী হয়েছিলো এবং শতাধিক ট্যাংক ধ্বংস হয়েছিলো। সেই যুদ্ধের জের ধরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান সহ অনেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
সেই যুদ্ধে ইরানের এলিট কমান্ডো ইউনিট আল কুদস এবং জেনারেল কাসেম সোলায়মানীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।
এজন্যই এটাকে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা ইরান ইসরাইল প্রক্সি ওয়ার ধরে থাকেন।
সুতরাং বর্তমান যুদ্ধে হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্র ধরে হিযবুল্লাহ এগিয়ে আসলে যুদ্ধ আরো ঘনীভূত হবে।
হিযবুল্লাহ এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনের পক্ষে এগিয়ে আসার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
সিরিয়ার সঙ্গেও ইসরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে।
ইসরায়েল মাঝেমধ্যেই সিরিয়ার ভেতরে বিমান আক্রমণ করে।
কিছুদিন আগে সিরিয়ার এক মিসাইল ইসরায়েলের আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ইসরায়েলের এক মিসাইল কারখানার পাশে পড়েছিলো।
সিরিয়ার জনগণের অধিকাংশ সুন্নি হলেও শাসক বংশ আলাওয়ি শিয়া এবং ইরানের সামরিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং তারাও জড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
সুতরাং এই পুরো যুদ্ধটা আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে।
তবে এই ঘটনায় জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার হয়ে রক্তাক্ত বধ্যভূমির মধ্যে থাকা ফিলিস্তিনি জনগণের অদম্য প্রতিবাদী সাহসের হাসিগুলো হৃদয় স্পর্শ করার মতো।
নিচের এই ছবিগুলো অনলাইন থেকে সংগৃহীত।
প্রথম ছবিটি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা Khaled Mashal এর।
তিনি একসময় শিক্ষকতা করতেন।
পরবর্তীতে ইসরায়েলের অমানবিক নিপীড়ন এবং ৬০ লাখ ফিলিস্তিনির জমিজমা ঘরবাড়ি সব দখল করে নেওয়ার ঘটনা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন সংগঠনের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
পরে রাজনৈতিক দলগুলোর আপোষমূলক দুর্বলচেতা কাজকর্মে পুরোপুরি হতাশ হয়ে তিনি বুঝতে পারেন যে অযোগ্য সুবিধাবাদী নেতৃত্বের পিছে ঘুরঘুর করে বা কোনো ধরণের অহিংস শান্তিবাদী অর্থহীন আন্দোলন দিয়ে ইসরায়েলের মতো অস্ত্র নির্ভর ফ্যাসিবাদী দানব রাষ্ট্রের মোকাবেলা কখনোই সম্ভব হবেনা।
ফলে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন নিজেই মাঠে নেমে পড়ার।
হাজারো সীমাবদ্ধতা, সরকারের রক্তচক্ষু, বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র আর ভয়াবহ সব চ্যালেঞ্জ থাকার পরেও কয়েকজন মিলে অতি সাবধানে অতি গোপনে সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন গোপন সশস্ত্র সংগঠন হামাস ।
অতি তুচ্ছ এবং নগণ্য সংগঠন হিসেবে শুরু হলেও আপোষহীন মানসিকতার জন্য হামাস সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জনের পর হামাস পরবর্তীতে প্রকাশ্য রাজনীতির প্রচারণাতেও নেমে আসে।
এই আশা, উদ্দীপনা এবং সাহস বিকীরণকারী ক্যারিশমাটিক নেতার সময় ২০০৬ সালে স্বাধীনতাকামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বিপুল ভোটে জিতে ফিলিস্তিনি সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
আমেরিকা ও ইসরাইল ফিলিস্তিনের এই অতি জনপ্রিয় নির্বাচিত নেতাকে বিপজ্জনক এবং দুর্ধর্ষ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করেছে।
জর্ডানের রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার সময় ইসরায়েল তাকে বিষ প্রয়োগে গুপ্ত হত্যার চেষ্টা করলে তিনি বিষক্রিয়ার প্রভাবে আক্রান্ত হয়েও পরবর্তীতে চিকিৎসার ফলে অল্পের জন্য বেঁচে যান।
মোসাদের গুপ্ত হত্যার শীর্ষ টার্গেট হবার ফলে মোস্ট ওয়ানটেড এই নেতা এখন নিরাপত্তার কারণে কাতারের রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন এবং সেখান থেকে দল পরিচালনায় ভূমিকা রাখছেন।
আমেরিকা, ইউরোপ এবং ইসরাইল ঐ সময় হামাসের দ্রুত উত্থানে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
তারা সহিংস প্রতিরোধ বাদ দিয়ে হামাসকে অহিংস এবং শান্তিবাদী হয়ে যাবার জন্য হুমকি দেয়।
বিনিময়ে সাহায্য, টাকা পয়সা এবং সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রলোভনও দেখায়।
বলা হয় অহিংস না হলে সকল অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সেই সময় ওনার একটা অসাধারণ লেখা বাংলায় অনুবাদ করে আমাদের দেশের পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
লেখাটার শিরোনাম ছিলো –
“সাহায্যের বিনিময়ে জনগণ কিংবা নীতি বিক্রি নয়”
খালেদ মেশআলকে সাংবাদিকরা একবার প্রশ্ন করলো যে,
হামাস সন্ত্রাসী সংগঠন না হলে ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের রকেট ছুড়ে হত্যা করছে কেনো?
খালেদ মেশআল হাসিমুখে উত্তর দিলেন –
নিখুঁতভাবে টার্গেটে লাগানোর মতো মিসাইল বা স্মার্ট বোমা আমাদের নেই।
আমাদের রকেটগুলো আসলে কোনোরকমে বানানো আনস্মার্ট অস্ত্র।
এজন্যই রকেটগুলো একদম চুলচেরাভাবে ঠিকজায়গায় মারা সম্ভব হয় না।
তবে, সমালোচক দেশগুলো যেমন আমেরিকা বা ইসরাইল যদি আমাদের হাতে স্মার্টবোমা বা মিসাইল তুলে দেয় তবে আমরা কথা দিচ্ছি যে আমরা শুধু বেছে বেছে ইসরায়েলী সেনাঘাঁটি আর ইসরায়েলি সৈন্যদেরই মারবো।
তবে একটা কথা মনে রাখবেন,
There are no civilians in Israel.
ইসরায়েলে কোনো বেসামরিক নাগরিক নেই।
কারণ বাধ্যতামূলক সরকারি সামরিক প্রশিক্ষণ নীতির আওতায় ইসরায়েলের সকল ইহুদি নাগরিককে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
এমনকি তাদের প্রাইমারি স্কুলের শিশুদের পর্যন্ত সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র চালানো শেখানো হয়।
তাছাড়া ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের হত্যার পর নিজেরাই জোরগলায় দাবী করেছে যে যুদ্ধের সময় কেউই নাকি বেসামরিক নাগরিক থাকেনা।
সুতরাং সেই হিসেবে হামাসও কখনো কোনো বেসামরিক নাগরিক হত্যা করেনি।
খালেদ মেশআলের বিখ্যাত উক্তি-
“আগামী দিনে আমাদের উম্মাহই দুনিয়ার সিংহাসনে বসে রাজত্ব করবে।
এটা কোনো অলীক কল্পনা না বরং নিরেট বাস্তবতা।
আগামী দিনে আমরাই নেতৃত্ব দেবো ইনশাল্লাহ।
আজকেই মাফ চান, পরে আর অনুতপ্ত হয়ে কোন লাভ হবেনা।
আমাদের উম্মাহর সামনে এগোনো শুরু হয়ে গেছে, সুতরাং বিজয়ী জাতিকে ইজ্জত আপনাদের নিজেদের স্বার্থেই করা উচিত।”
FreePalestine
লেখা: মুসতাসীম তানজীর।