বিশ্ব জুড়ে গত বছর করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার সময় একমাত্র টিকার মাধ্যমে এমন সংকট থেকে রেহাই পাবার আশা প্রকাশ করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তারপর অভূতপূর্ব গতিতে একের পর এক কোম্পানি করোনা প্রতিষেধক আবিষ্কার করে জনজীবন স্বাভাবিক করার পথ সুগম করে দেয়। যদিও অনুমোদন, উত্পাদন, রপ্তানি, স্বত্ব নিয়ে জটিলতার মতো নানা চ্যালেঞ্জের কারণে এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ করোনা টিকা পাননি।
মূলত ধনী দেশগুলোই দুর্লভ টিকার সিংহভাগ দখল করে বসে আছে। অথচ মানবজাতি দ্রুত এই রক্ষাকবচ না পেলে ভাইরাস আরো রূপান্তর ঘটিয়ে প্রাথমিক সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনই প্রেক্ষাপটে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ১০০-র বেশি দেশ করোনা টিকার পেটেন্ট বা মেধাস্বত্ব সাময়িক প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে। এমনটা সম্ভব হলে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে কোনো কোম্পানি বিনা জটিলতায় সেই টিকা উত্পাদন করতে পারবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এবার এমন উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানালেন। অথচ অতীতে প্রায় সব মার্কিন প্রশাসনই যে কোনো অবস্থায় মেধাস্বত্ব শিথিল করার তীব্র বিরোধিতা করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ মধ্যস্থতাকারী ক্যাথারিন টাই এমন অবস্থানের ব্যাখ্যা করে বলেন, বিশ্ব জুড়ে এমন স্বাস্থ্য সংকটের ফলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলা করতে অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিতে হবে। তার আশঙ্কা, ভারতে বর্তমানে ব্যাপক আকারে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের ফলে মিউটেশনের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের এমন সংস্করণ সৃষ্টি হতে পারে, যেগুলো টিকা উপেক্ষা করে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বলাবাহুল্য, টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করছে। তাদের যুক্তি, টিকা আবিষ্কার এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী টিকার ক্রমাগত নবায়নের জন্য গবেষণায় বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। একমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থেই এমন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা সম্ভব। মেধাস্বত্বের ওপর কোম্পানির অধিকার প্রত্যাহার করলে বাজার থেকে সেই অর্থ সংগ্রহের উপায় থাকবে না। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা উত্পাদনের লক্ষ্যে ২০০-র বেশি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ফলে টিকা তৈরির কাঁচামালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সমন্বয় নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে বলে ওষুধ কোম্পানিগুলি দাবি করছে। উল্লেখ্য, বাইডেন প্রশাসনের সমর্থনের খবর প্রকাশিত হবার পর পুঁজিবাজারে মডার্না ও নোভাভ্যাক্স কোম্পানির দরপতন ঘটেছে। আমেরিকার ওষুধ কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে এমন সিদ্ধান্ত প্রতিরোধ করবে বলে জানিয়েছে।
মার্কিন প্রশাসনের নীতিগত সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও এমন উদ্যোগ কার্যকর করতে অনেক মাস সময় লাগবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৬৪টি সদস্য দেশের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলাও সহজ কাজ নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেন এখনো সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়নি। মূল্যবান সময় নষ্ট না করতে বাইডেন প্রশাসন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টিকা উত্পাদন বাড়ানো ও টিকা তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
করোনার টিকা নিয়ে বিশ্বের উন্নত ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলেছে, কোনো কোনো উন্নত দেশ তাদের অর্ধেকের বেশি নাগরিককে টিকা দিয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশ শতভাগ টিকা দিয়েছে। তবে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই হার ১০ শতাংশের নিচে। এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মানছে না কোনো দেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে টিকা বণ্টনের কথা থাকলেও কেউ তা মানেনি। আমেরিকা তাদের দেশের ৫০ শতাংশ নাগরিককে টিকা দিয়েছে। ভারতে এই হার ৯ শতাংশ। ইসরাইলসহ বেশ কয়েকটি দেশ শতভাগ মানুষের টিকা দিয়েছে। ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে টিকা এসেছে ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ। এর মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ পাচ্ছে না ১৬ লাখ মানুষ।
এদিকে বর্তমানে যে টিকা দেওয়া হচ্ছে তা শতভাগ কার্যকর নয়। টিকা নেওয়ার পর কতদিন ভালো থাকা যাবে তা নিয়েও গবেষণা চলছে। শতভাগ কার্যকর টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে অনেক দেশ। তবে আবিষ্কার হলেও উন্নত দেশগুলো তা পাবে, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বঞ্চিত হবে। কোনো দেশের টিকা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও সংক্রমণের হারের ওপর। ১৩০টি দেশ এখনো টিকা পায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, টিকার ক্ষেত্রে ছোট-বড় সব দেশকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে বিশ্ব ভাইরাস থেকে মুক্ত হতে পারবে। কোনো দেশ ক্ষমতাবলে টিকা শতভাগ দিলে কিন্তু ঐ দেশ করোনা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। পার্শ্ববর্তী দেশ টিকা না পেলে আবারও ভাইরাসটি ছড়াবে। তাই টিকার ক্ষেত্রে সবাই একযোগে কাজ করলে ভাইরাসটি সহজে নির্মূল করা সম্ভব।
সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক এবং মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্যাভিসহ সব সংস্থা এবং টেকনোলজি সমন্বয় করে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। বিশ্ব থেকে করোনা ভাইরাস নির্মূল করতে হলে এক সঙ্গে কাজ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। কারণ পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে তা নিজের ঘরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে নিরাপদে না রাখলে নিজেও নিরাপদে থাকা যাবে না। তিনি বলেন, ১৩০টি দেশ টিকা পায়নি। এ কারণে বিশ্ব ঝুঁকিতে আছে।