কোভিড-১৯-এর টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পরও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক কম। টিকা নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত ২০০ জনের ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে ৮৮ শতাংশের বেশি রোগীর শ্বাসকষ্ট ছিল না। ৯২ শতাংশ রোগীর অক্সিজেন লাগেনি।
গবেষণাটি করেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) একদল গবেষক। গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত এই গবেষণা চালানো হয়। যাঁদের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়, তাঁরা ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছিলেন।
সিভাসুর উপাচার্য অধ্যাপক গৌতম বুদ্ধ দাশের নেতৃত্বে এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শারমিন চৌধুরী, শিক্ষক ইফতেখার আহমেদ এবং চার ভেটেরিনারি চিকিৎসক ত্রিদীপ দাশ, প্রাণেশ দত্ত, সিরাজুল ইসলাম ও তানভীর আহমদ নিজামী।
গবেষণা সম্পর্কে অধ্যাপক গৌতম বুদ্ধ দাশ প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণকারীরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলেও যাঁরা টিকা গ্রহণ করেননি, তাঁদের তুলনায় স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই বললেই চলে। তাঁদের মৃত্যুঝুঁকিও কম। তাই টিকা নিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করা জরুরি।
সিভাসু কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষাগারে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৬ হাজার ১৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। যার মধ্যে ১ হাজার ৭৫২ জনের (সাড়ে ২৮ শতাংশ) করোনা পজিটিভ হয়। এর মধ্যে ২০০ জন ছিলেন টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণকারী।
টিকা গ্রহণকারী আক্রান্তদের সঙ্গে টিকা না নিয়ে আক্রান্তদের কয়েকজনের সঙ্গে আমরা তুলনা করেছি। টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণকারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা তুলনামূলক অনেক কম ছিল। তাঁরা অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত ছিলেন।
শারমিন চৌধুরী, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০০ জনের মধ্যে ১৬৫ জনকে (৮২.৫ শতাংশ) হাসপাতালে যেতে হয়নি। ৩৫ জনকে (১৭.৫ শতাংশ) হাসপাতালে ভর্তি হতে হলেও তাঁদের মারাত্মক কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
কোভিড আক্রান্ত কিছু রোগীর মারাত্মক শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। সিভাসুর গবেষণায় এসেছে, টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে ১৭৭ জনের (৮৮.৫ শতাংশ) কোনো শ্বাসকষ্ট হয়নি। ১৮৪ জনের (৯২ শতাংশ) অক্সিজেন দিতে হয়নি। যাঁদের শ্বাসকষ্ট ও অতিরিক্ত অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে, তাঁদের বার্ধক্যজনিতসহ নানা সমস্যা ছিল।
করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সাধারণত প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, হাঁচি ও কাশি। গবেষণায় দেখা যায়, টিকা গ্রহণকারী রোগীদের ক্ষেত্রে ৮৯ জনের (৪৪.৫ শতাংশ) ও ১৮২ জনের (৯১ শতাংশ) কাশি ও হাঁচি ছিল না। বাকি যাঁদের ছিল, তিন থেকে সাত দিনের মাথায় তা চলেও গেছে। ১১৩ জনের (৫৬.৫ শতাংশ) স্বাদ ও ১১১ জনের (৫৫.৫ শতাংশ) ঘ্রাণে কোনো পরিবর্তন ছিল না।
টিকা গ্রহণকারী রোগীদের গড়ে অক্সিজেন স্যাচুরেশন পাওয়া যায় ৯৬ দশমিক ৮ শতাংশ। যাঁদের শ্বাসকষ্ট হয়েছিল, তা গড়ে পাঁচ দিনের বেশি ছিল না। তাঁদের সর্বনিম্ন অক্সিজেন স্যাচুরেশন পাওয়া যায় ৯০ শতাংশ। যাঁরা টিকা গ্রহণ করেননি, তাঁদের বেশির ভাগের সর্বনিম্ন অক্সিজেন স্যাচুরেশন ছিল ৮৫ শতাংশ।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০০ জনের মধ্যে ১৬৫ জনকে (৮২.৫ শতাংশ) হাসপাতালে যেতে হয়নি। ৩৫ জনকে (১৭.৫ শতাংশ) হাসপাতালে ভর্তি হতে হলেও তাঁদের মারাত্মক কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
যে ২০০ জনের ওপর গবেষণা চালানো হয়েছে, তাঁদের মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণের পরও আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে কেবল একজনকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা নিতে হয়েছে। ছয় দিন পর তিনি মারা যান। ৪৮ বছর বয়সী এই রোগী আগে থেকে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।
সিভাসুর প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘টিকা গ্রহণকারী আক্রান্তদের সঙ্গে টিকা না নিয়ে আক্রান্তদের কয়েকজনের সঙ্গে আমরা তুলনা করেছি। টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণকারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা তুলনামূলক অনেক কম ছিল। তাঁরা অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত ছিলেন।’
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আক্রান্তদের মধ্যে বয়স ও লিঙ্গভেদে ১২৯ (৬৪.৫ শতাংশ) জন আগে বিভিন্ন স্বাস্থ্যজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। যার মধ্যে ৩৬ জন উচ্চ রক্তচাপ, ৩২ জন ডায়াবেটিস ও ৫ জনের অ্যালার্জি ছিল। ৫১ জন ছিলেন একাধিক রোগে আক্রান্ত।
এমনিতে আমরা যেসব রোগী পাচ্ছি, তাতে দেখা যায় টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে করোনা হলেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কম দেখা দিচ্ছে। টিকার দ্বিতীয় ডোজও সবাইকে নিতে হবে।
অনিরুদ্ধ ঘোষ, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
গবেষণায় দেখা যায়, আক্রান্তদের অধিকাংশ টিকা নেওয়ার গড়ে ৩২ দিন পর আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁদের শরীরের গড় তাপমাত্রা ছিল ১০১°ডিগ্রি। লিঙ্গ ও বয়সভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৯৯°ডিগ্রি থেকে ১০৪°ডিগ্রি।
এ গবেষণা সম্পর্কে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণাটি অবশ্যই ইতিবাচক। এটা আরও বড় পরিসরেও হতে পারে। এতে টিকায় মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, ‘এমনিতে আমরা যেসব রোগী পাচ্ছি, তাতে দেখা যায় টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে করোনা হলেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কম দেখা দিচ্ছে। টিকার দ্বিতীয় ডোজও সবাইকে নিতে হবে।’