মোঃ রেজওয়ানুল ইসলাম
মৌলিক অধিকারঃ-
সমাজে মর্যাদাপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে একজন মানুষের যেসব অধিকার দরকার, সেগুলো মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এসবের মধ্য থেকে কিছু অধিকারকে মৌলিক হিসেবে ঘোষণা করে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের 27 থেকে 44 পর্যন্ত 18 টি মৌলিক অধিকারের কথা আলোচনা করা হয়েছে। 6 টি মৌলিক অধিকার (32, 33, 34, 35, 41, 44) দেশী ও বিদেশী সকলেই ভোগ করতে পারে এবং বাকি 12 টি মৌলিক অধিকার শুধুমাত্র বাংলাদেশি জনগণই ভোগ করতে পারে। এই মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে রাষ্ট্র প্রতিকার দিতে বাধ্য থাকে। সংবিধান এর 26 নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয় তবে তা বাতিল হয়ে যাবে। সরকার বা মন্ত্রিপরিষদ ইচ্ছা করলেই মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন তৈরি করে এর ব্যত্যয় ঘটাতে পারবে না।
বিশেষ বিশেষ মৌলিক অধিকার:
যেমন-
– সমতার অধিকার
– স্বাধীনতার অধিকার
– শোষিত না হওয়ার অধিকার
– ধর্মীয় অধিকার
– সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার অধিকার
– বাক স্বাধীনতার অধিকার
– জীবন রক্ষার অধিকার
—ইত্যাদি।
এগুলোর লঙ্ঘনে সাংবিধানিক প্রতিকার রয়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মানবাধিকার মানুষের জন্মগত। আর মৌলিক অধিকার হলো আইনিভাবে স্বীকৃত।
সহজভাবে মৌলিক অধিকার বলতে বুঝা যায় যে, সংবিধান স্বীকৃত যেসকল মানবাধিকার রাষ্ট্র বলবৎ করতে বাধ্য সেগুলোকেই মৌলিক অধিকার বলা হয়। যেহেতু সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সেহেতু মৌলিক অধিকারগুলোও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অধিকার হিসেবে স্বীকৃত।
মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনে প্রতিকারঃ-
কারো মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে সংবিধানের 44(ক) অনুচ্ছেদ প্রদত্ত অধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য যে কোন সংক্ষব্ধ ব্যক্তি রীট পিটিশন দায়ের করতে পারে এবং হাইকোর্ট বিভাগ 102(1) ও (2) অনুচ্ছেদ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে রীট এর ভিত্তিতে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য কতিপয় আদেশ নির্দেশ জারী করতে পারে।
️রীট (Writ): রীট শব্দের অর্থ হল আদালত বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঘোষিত বিধান বা আদেশ।
বাংলাদেশের সংবিধান হাইকোর্ট বিভাগকে শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রে আদি এখতিয়ার দিয়েছে, সেটি হল রীট জারীর এখতিয়ার। সংবিধানের 102(1) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ কারো মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে তা বলবৎ করতে পারে এবং বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনাকে কার্যকর করতে পারে। হাইকোর্ট বিভাগের এই এখতিয়ার কে রীট জারীর এখতিয়ার বলে। অর্থাৎ রীট শুধু মাত্র হাইকোর্ট বিভাগ জারী করতে পারে।
রীটের প্রকারভেদ: বাংলাদেশ সংবিধানের 102(2) অনুচ্ছেদ অনুসারে পাচটি ক্ষেত্রে পাঁচ ধরণের রীট করা যায়,
যেমনঃ
1) বন্দী প্রদর্শন (Writ of Habeas Corpus)ঃ Habeas Corpus কথাটির শাব্দিক অর্থ হলো “To have the body before the court” অর্থাৎ “বন্দী ব্যক্তিকে সশরীরে হাজির করা”। কোন ব্যক্তি যদি মনে করে তাকে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং বিনা অপরাধে সংবিধানের অনুচ্ছেদ 27, 28, 32, 33, 35, 36, 37, 38, 39, 40 41, 43) এর প্রদত্ত অধিকার লঙ্ঘন করে আটক রাখা হয়েছে তাহলে সে হেবিয়াস কর্পাস-এর জন্য আবেদন করতে পারে। সেই আবেদন গ্রাহ্য হলে আদালত কারাগার-কর্তৃপক্ষকে হুকুম দিবে কয়েদীকে আদালতে নিয়ে আসতে – যাতে আদালত বিচার করে দেখতে পারে যে, তাকে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কিনা। হেবিয়াস কর্পাস-এর জন্য আবেদন কারারুদ্ধ ব্যক্তি নিজে অথবা অন্য কেউ তার জন্য করতে পারে। এই আবেদনে দেখাতে হবে যে, আদালত কারারুদ্ধ ব্যক্তিকে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বা আইনের অপপ্রয়োগ করে কারাদণ্ড দিয়েছে। অনেক সময়ে কোন বিচারক কাউকে আদালত-অবমাননার দায়ে জেলে পাঠাতে চাইলে, সেই ব্যক্তি হেবিয়াস কর্পাস-এর জন্য আবেদন জানাতে পারে। যে কোন সংক্ষব্ধ ব্যক্তি বন্দী প্রদর্শনের জন্য আবেদন করতে পারে।
2) পরমাদেশ বা হুকুমজারি রীট (Writ of mandamus)ঃ
Mandamus এর অর্থ “We command” অর্থাৎ “আমরা আদেশ বা হুকুম করছি”।
বস্তুত এটি কোন অধঃস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, ব্যক্তি বা সরকারী সংস্থাকে দেওয়া একটি আদেশ। তারা যখন আইন অনুসারে কোনও কাজ করায় গাফিলতি করে, তখন তাকে আইন অনুযায়ী কাজ করার আদেশ দেওয়া হয়। কোন অধঃস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, ব্যক্তি বা সরকারী সংস্থা যদি মৌলিক অধিকারগুলোর(27-44) কোনটি লঙ্ঘন করে এবং আইনি কার্য পরিচালনা করতে অস্বীকার করে বা ব্যর্থ হয় তাহলে উচ্চ আদালত আদেশজারী করতে পারে। যে কোন সংক্ষব্ধ ব্যক্তি হুকুমজারীর জন্য আবেদন করতে পারে।
3) প্রতিষেধক বা নিষেধাজ্ঞা মূলক রীট (Writ of prohibition)ঃ
কোন অধঃস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কোন কতৃপক্ষ, সংস্থা বা ব্যক্তি তার এখতিয়ার বহির্ভূত (in excess of jurisdiction) কাজ করতে উদ্দ্যত হয়েছে কিংবা স্বাভাবিক ন্যায়-নীতি (principle of natural justice) ভঙ্গ করতে যাচ্ছে-এ অবস্থায় উচ্চতর আদালত যে আজ্ঞার মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তি বা কতৃপক্ষকে উক্ত কাজ করা থেকে বিরত রাখেন তাকে নিষেধাজ্ঞামূলক রীট বলে। উল্লেখ্য, নিষেধাজ্ঞামূলক রীটকে বিচার বিভাগীয় রীট বলা হতো। কারন, এটি শুধুমাত্র কোন বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় (quasi-judicial) সংস্থার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যেত । কোনো প্রশাসনিক সংস্থা বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যেত না। কিন্তু ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধান ও বাংলাদেশের সংবিধান যেভাবে বিধান করেছে তাতে নিষেধাজ্ঞামূলক রীটকে আর বিচার বিভাগীয় রীট বলা যায় না। কারণ, ইহা বর্তমানে বাংলাদেশে যে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যায়।
কোন অধঃস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, ব্যক্তি বা সরকারী সংস্থা যদি মৌলিক অধিকারগুলোর(27-44) কোনটি লঙ্ঘন করে কোন কার্য পরিচালনা করে এবং এখতিয়ার বহির্ভূত কোন কাজ করতে উদ্যত হয় তাহলে উচ্চ আদালত উক্ত কাজ থেকে বিরত থাকতে আদেশজারী করতে পারে। যে কোন সংক্ষব্ধ ব্যক্তি হুকুমজারীর জন্য আবেদন করতে পারে।
4) উৎপ্রেশন রীট (Writ of certiorari)ঃ Certiorari অর্থ হলো “To be certified” বা “বিশেষভাবে জ্ঞাত হওয়া”। কোন আদালত ট্রাইবুনাল বা কোন ব্যক্তি বা কোন সংস্থা যদি তার আইনানুগ ক্ষমতা লংঘন করে কিংবা principle of natural justice যদি ভঙ্গ করে তবে উচ্চতর আদালত যে আদেশ এর মাধ্যমে উক্ত কাজকে নাকচ করে দেয় তাকে উৎপ্রেষণ রীট বলে।
দুটি উদ্দেশ্যে উচ্চতর আদালত উৎপ্রেষণ রীট জারি করতে পারে –
- অধীনস্থ কোন আদালত বা ট্রাইবুনাল বা ব্যক্তি বা সংস্থা কর্তৃক ক্ষমতা বহির্ভূত কাজ কে বাতিল বা নাকচ করে দেওয়া ।
2.অধীনস্থ আদালত বা ট্রাইব্যুনালের কোনো মামলার শুনানির জন্য উচ্চতর আদালত নিজেই গ্রহণ করার জন্য জারি করতে পারে ।
উচ্চ আদালত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ব্যপারে জানতে পারলে নিম্ন আদালতের যে কোন আদেশ বাতিল করে দিতে পারে।
5) কারণ দর্শাও রীট (Writ of Quo-Warranto)ঃ Quo-Warranto কথাটির অর্থ হলো “by what warrant or authority” কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন সরকারি পদ দাবি করে যে পদের যোগ্যতা তার নেই অথবা অবৈধভাবে যদি কোন সরকারি পদ দখল করে বসে থাকে, তাহলে উচ্চতর আদালত যে আদেশের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিকে তা পদ দখলের বা দাবির কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে থাকে তাকে কারণ দর্শাও রীট বলে । এই রীটের মাধ্যমে উচ্চতর আদালত উক্তরূপ দাবীর বৈধতা অনুসন্ধান করে এবং দাবি বা দখল যদি অবৈধ প্রমাণিত হয় তাহলে আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পদচ্যুত করার নির্দেশ দিতে পারে।
আবেদনকারীকে সংক্ষুব্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই; যেকোনো ব্যক্তি কারণ দর্শাও রীট জারির আবেদন করতে পারে । এক্ষেত্রে সংবিধান এর অনুচ্ছেদ 29 এর লঙ্ঘন এর ক্ষেত্রে বেশী কার্যকরী। এছাড়াও, এরকম অন্যান্য অনুচ্ছেদ এর লঙ্ঘনের মাধ্যমে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যদি কোন ব্যক্তিকে উক্ত পদে রাখা হয় তাহলে উচ্চ আদালতের আদেশক্রমে উক্ত পদ থেকে পদচ্যুত করা যাবে।
তবে দুটি ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলেও প্রতিকার দাবি করা যাবে না।
তা হলোঃ-
- সংবিধান এর 47 অনুচ্ছেদ এর বিধানসমূহ কার্যকর করার ক্ষেত্রে 102(3) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রীট করা যাবে না।
- জরুরি অবস্থা ঘোষণা কালে সংবিধানের অনুচ্ছেদ 141(গ) অনুসারে মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত হয়ে যাবে।
মৌলিক অধিকার একটি দেশের জনগনণের ন্যায্য অধিকার । প্রশাসন তথা অন্য কেউ অবৈধভাবে এসব অধিকার লঙ্ঘন করতে পারবে না। মৌলিক অধিকারগুলোই একটি দেশের গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা নিরূপন করে। মৌলিক অধিকারের গ্রহনযোগ্যতার ভিত্তিতে বুঝা যায়, সে দেশটি কতটা গণতান্ত্রিক।
লেখকঃ মোঃ রেজওয়ানুল ইসলাম, আইন তৃতীয় বর্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।