বিদেশ থেকে অনলাইনে টিকিট কিনে বাংলাদেশ থেকে দেদারছে মানব পাচার হচ্ছে। লেবানন, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে টিকিট কাটার কারণে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের বাংলাদেশস্থ জিএসএগুলো এ বিষয়ে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের কিছু ট্রাভেল এজেন্ট বিদেশি ট্রাভেল এজেন্সির পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে টিকিট বিক্রির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কারা টিকিট কাটছে কিংবা কীভাবে কাটছে, সেটিও অনেক সময় আগেভাগে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না।
এদিকে বাংলাদেশে কড়াকড়ির কারণে ভারতকে মানব পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। সড়কপথে বা অন্য কোনো উপায়ে ভারতে যাওয়ার পর সেখান থেকে আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় হতভাগ্যদের। এক্ষেত্রে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসকে ব্যবহার করা হয়।
গত কয়েক দিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে নিহত ২৪ জনের মধ্যে অন্তত ১২ জনকে ভারত হয়ে পাচার করা হয়েছে। এরা সবাই ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের যাত্রী। দিল্লি ও মুম্বাই থেকে তারা বিভিন্ন দেশ হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছায়। মানব পাচারের বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, অতীতে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের টিকিট কেটে পাচারকারীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এয়ারলাইনসের মাধ্যমে মানব পাচার করত।
২০১৬ সালের একটি ঘটনার পর সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। তখন র্যাব হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভিযান চালিয়ে পাচার হতে যাওয়া দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একজন শীর্ষ পাচারকারী আটক হয়। এর পরও পাচারকারীরা বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কাছে টিকিট কাটতে চাইলে তাদের না করে দেওয়া হয়। কয়েকটি এয়ারলাইনসের কর্মকর্তাদের তারা ভয়ভীতিও দেখায়। এতে কাজ না হলেও পাচারকারীরা তাদের কৌশল পালটে ফেলে।
বাংলাদেশের একদল ব্যবসায়ী মিলে পাচারের বিষয়টি পুরো কবজা করতে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেন। তারা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের অফলাইন জিএসএ (বাংলাদেশে অফিস খুলে টিকিট কেটে ইথিওপিয়ায় পাঠানো) নেয়। বাংলাদেশ থেকে যাত্রীদের ভারতে পাঠিয়ে সেখান থেকে পাচার শুরু করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের অফলাইন জিএসএ নিয়েছে মাস্ ট্রাভেলস। এর মালিক সোহাগ হোসেনকে ইতিমধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তারা সম্প্রতি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের জিএসএ নিয়েছে বলেও জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাচারের উদ্দেশ্যে পাচারকারীরা অনেক সময় অনলাইনের মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে টিকিট কেটে থাকে। লেবানন, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে টিকিট কাটার কারণে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের বাংলাদেশস্থ জিএসএগুলো তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
জানা গেছে, বিদেশি এয়ারলাইনসের মাত্র ৩০ শতাংশ টিকিট স্থানীয় পর্যায়ে কাটা হয়। বাকি ৭০ শতাংশ টিকিট কাটা হয় দেশের বাইরে থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আফ্রিকার যেসব দেশে অন অ্যারাইভাল ভিসার (অবতরণকালীন ভিসা) ব্যবস্থা আছে, সেসব দেশকে টার্গেট করেছে পাচারকারীরা। ভারত কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে বাংলাদেশিদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় আফ্রিকার ঐ সব দেশে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যায়। তবে যাদের ভারত দিয়ে পাচার করা হয়, তাদের অধিকাংশই সড়কপথে ভারতে গমন করে বলে জানা গেছে।
লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের হাতে ২৪ জন নিহত হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করছে সিআইডি। এ বিভাগের ডিআইজি (অর্গানাইজড ক্রাইম) ইমতিয়াজ আহমেদ এ বিষয়ে ইত্তেফাককে বলেন, সাধারণত ১০টি রুট দিয়ে ছয়টি দেশে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার হয়। আটটি দেশ হয়ে পাচারকারীরা হতভাগ্যদের গন্তব্যে পৌঁছায়। যত বেশি দেশ তারা ঘোরাবে, তত বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, ভারত, দুবাই, সুদান, মরক্কো লিবিয়া, আলজেরিয়া হয়ে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেয় পাচারকারীরা। ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইটালি, স্পেন এখন পাচারকারীদের পছন্দের জায়গা বলে তিনি জানিয়েছেন। ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, পাচারের বিষয়টি তদন্ত করতে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। তদন্তে যাদের নাম আসবে, তাদের কাউকে ছাড়া হবে না।
অনলাইনে টিকিট বিক্রি করে মানব পাচার
বাংলাদেশের কিছু ট্রাভেল এজেন্ট বিদেশি ট্রাভেল এজেন্সির পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে টিকিট বিক্রি করছে। এসব টিকিটে মানব পাচার ছাড়াও দেশ থেকে অর্থ পাচারের কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। অনলাইনে টিকিট বিক্রির টাকা সরাসরি চলে যাচ্ছে বিদেশের ট্রাভেল এজেন্সির একাউন্টে। এতে সরকার বিভিন্ন ধরনের কর থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, টিকিট বিক্রির জন্য বিভিন্ন এয়ারলাইনস বাংলাদেশে জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগ দিয়ে থাকে। তারা এয়ারলাইনসের পক্ষে টিকিট বিক্রির পর কমিশনের টাকা দেশে রেখে বাকি টাকা বিদেশি এয়ারলাইনসের একাউন্টে পাঠিয়ে থাকে। টিকিট বিক্রির অর্থের ওপর সরকারকে নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে থাকে। কিন্তু অনলাইন ট্রাভেল এজেন্ট গ্রাহকদের কাছ থেকে নগদ কোনো অর্থ গ্রহণ করে না। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের অর্থ সরাসরি চলে যায় বিদেশি এয়ারলাইনসের একাউন্টে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ ভ্যাট-ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কয়েক দিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি বিদেশি ট্রাভেল এজেন্টের ওয়েবসাইট ব্যবহার করে বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্টগুলো টিকিট বিক্রি করছে। এসব দেশি এজেন্ট এবং তাদের ব্যবহার করা ওয়বেসাইট হচ্ছে—ট্রিপ অ্যান্ড কেয়ার (ট্রিপএনকেয়ার ডটকম), জিটিআরআর (জিটিআরআরট্রাভেলস ডটকম), আকবর ট্রাভেলস (এক্সইন্ডিয়া ডট আকবরট্রাভেলসঅনলাইন ডটকম), স্টার ডিএমসি (স্টারডিএমসি ডটকম), নিড৮২ (নিড৮২ ডটকম), ভিয়া ডটকম (ইন ডট ভিয়া ডটকম), টিভিও হলিডেজ (ট্রাভেলবুটিকঅনলাইন ডটকম), মাইসটিফ্লাই ( মাইসটিফ্লাই ডটকম)।
এছাড়া বাংলাদেশের বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সি বিদেশি কোম্পানির পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশে টিকিট বিক্রি করছে। এসব এজেন্সি হচ্ছে—এক্সিকিউটিভ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, ট্রাভেল সলিউশন লি., হাল ট্রাভেল সার্ভিসেস লি., ট্রাভেল জু বিডি, মাহিমা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, ট্যুর প্ল্যানার্স লি., আইকন হলিডেজ, ক্রিস্টাল ওয়ে ট্রাভেলস, লেক্সাস ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ভিভিড হলিডেস লিমিটেড, বি ফ্রেস, পপুলার ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, ফ্লেমিংগো ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস লি., আল সিরাজ ট্রাভেলস, স্কাইনেট জার্নি অ্যান্ড রেস্ট, উইংস ক্লাসিক ট্যুরস, সুন্দরবন ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলস, এয়ার বাংলাদেশ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, মক্কা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, নরসিংদী ট্যুরস, বুক হোটাক ও ট্রাভেল বুকিং।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, অনলাইনে টিকিট বিক্রি করার কারণে সরকার বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সাধারণত দেশীয় ট্রাভেল এজেন্টরা বৈধ উপায়ে যেসব টিকিট বিক্রি করে, সেগুলোর ওপর সরকার দশমিক ৩ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) পেয়ে থাকে।